আমরা নজরুল ইসলাম বাবুর দালাল

'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার'- এই গানের কথা লিখে বিজয়ের মাসে অনেকেই স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। শুধু বিজয়ের মাসে নয়, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের যে কোনো গৌরবময় অর্জনেও আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে এই গানের কথার আশ্রয় নিয়ে থাকি। এই গান ছাড়াও আমরা গাই 'সব কটা জানালা খুলে দাও না' অথবা 'আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা'। কে এই অবিনশ্বর গান লিখেছেন? তার নাম জানার কথা একবারও মনে হয়নি আপনার? অমর গানগুলো লিখেছেন গীতিকবি ও মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবু। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তার মতো কিংবদন্তিতুল্য গীতিকবির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও। অবিশ্বাস্য বললাম এজন্য যে, বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না তিনি এখন পর্যন্ত স্বাধীনতা বা একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় কোনো পদক পাননি।
স্বাধীনতাকামী তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু ভারত থেকে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সম্মুখ সমরে লড়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধের অবসরে তুরার পাহাড়ে লিখেছেন দেশের জন্য গান। কলম ও অস্ত্র দুটোই সমান দক্ষতায় চালাতেন বাবু। এমন মহৎ মানুষকেও কি রাষ্ট্র ভুলে যায়? যদি ভুলে না গিয়ে থাকে তবে কেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালেও কালজয়ী দেশের গানের স্রষ্টা ও মুক্তিযোদ্ধা বাবুকে রাষ্ট্রীয় কোনো পদকে ভূষিত করা হয়নি?
সম্পর্কিত খবর
১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবু। বাবা বজলুল কাদেরের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। ১৯৯০ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান বাবু। ১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' চলচ্চিত্রের গান রচনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। রাকিব হাসানের সঞ্চালনায় সেই অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সুরকার ও সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান এবং নজরুল ইসলাম বাবুর স্ত্রী শাহীন আক্তার। চোখে জল নিয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে শাহীন আক্তার ক্ষোভ ও আশার কথা বলছিলেন- চাইলে তিনি চাকরি করতে পারতেন। তিনি দেশ স্বাধীন করে একটি প্রেস দিয়েছিলেন। সেখান থেকেও ছোট কাগজ বের করবেন। পরে সবকিছু বাদ দিয়ে গানেই ঝুঁকে পড়লেন। গানই ছিল তার সম্বল। তার মৃত্যুর এত বছর পরেও রাষ্ট্র তাকে যোগ্য সম্মান প্রদান করেনি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে এক দিন সম্মানিত করা হবে- এই আশায় এখনও বেঁচে আছি।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ খবর রাখেন নজরুল ইসলাম বাবু ও তার পরিবারের। বাবুর দুই মেয়ে নাজিয়া ও নাফিয়ার কথা পর্যন্ত তিনি জানেন। বলছিলেন বাবুর আদ্যোপান্ত জীবনী। মহৎ কোনো মানুষকে পদক পাওয়া-না পাওয়া দিয়ে চূড়ান্ত বিচার ঠিক নয় বলে মনে করেন কে এম খালিদ। আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, জাতি তাকে গানের মাধ্যমে স্মরণ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে তার নাম প্রচারের চেষ্টা আমরা করছি। কালজয়ী গানের গীতিকবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে সম্মানিত করা যায় সেই চেষ্টা আমরা করছি।
নজরুল ইসলাম বাবুর জন্মজেলা জামালপুরে তার একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা যায় কিনা একটু ভেবে দেখবে জামালপুরের মানুষ অথবা প্রশাসন। বাংলাদেশে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ভাস্কর্য স্থাপন অথবা রাষ্ট্রীয় পদক তো অনেক দূরের বিষয়। আমি বিশ্বাস করি, সবকিছু এখনও দালালদের খপ্পরে চলে যায়নি। নজরুল ইসলাম বাবুর স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদক পেতে যদি দালালের প্রয়োজন হয়; তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের নাগরিক সবাই আমরা নজরুল ইসলাম বাবুর দালাল।
লেখক: নাট্যকার ও সাংবাদিক
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস