• বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
  • ||

১৯৭১ সালের গণহত্যা: ক্ষমা ও স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশের চেষ্টা

প্রকাশ:  ২৭ মে ২০২৩, ০১:৩২
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, “এই নিপীড়ন তখন পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেনি। এখনও করবে না। তিনি গনহত্যার কথা উল্লেখ না করলেও তার বক্তব্যে পাকিস্তানি সেনাদের বাংলাদেশে করা অপরাধের কথাই তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে।

২০২২ সালের অক্টোবরে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫১ তম অধিবেশনে জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি (ইউএন) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর করা গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। নাহয় এই অধ্যায় হারিয়ে যেতে থাকবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এখনও পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। এমনকি বাংলাদেশে তাদের চালানো ব্যাপক গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার কারণে এখনও দুই দেশের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। ফলে তারা স্বায়ত্বশাসনের দাবি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) নেতৃত্ব বিষয়টির গণতান্ত্রিক সমাধানের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানে সহিংস পন্থা অবলম্বন করে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে, যা অখন্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে প্রমাণিত হয়। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উপর ব্যাপক ক্র্যাকডাউন শুরু করে। একপর্যায়ে ভারতের সাথেও যুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীকালে তাদের অপমান ও আত্মসমর্পণ ঘটে।

বাংলাদেশের দাবি, যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় এবং আরও লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়।

১৯৭১ সালের গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ওই বছরের ১৩ জুন প্রথম বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস-এ।

মাসকারেনহাস জেনোসাইড শিরোনামে তার বিখ্যাত প্রতিবেদনে গণহত্যা সম্পর্কে লিখেন, আমি হিন্দুদের গ্রাম থেকে গ্রামে এবং দ্বারে দ্বারে শিকার হতে দেখেছি। তারা সরাসরি দেখতো কার কার খতনা করা হয়নি। কুমিল্লার সার্কিট হাউসের কম্পাউন্ডে রক্তাক্ত মানুষের চিৎকার শুনেছি।

১৯৭১ সালে ঢাকায় মার্কিন কাউন্সিলের জেনারেল কে. ব্লাড বাংলাদেশের সংগ্রাম পরিচালনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।

পরে তিনিও প্রতিবেদন দিয়ে লেখেন, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে খালি নারীদের লাশ সিলিং ফ্যানে দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তারা পাকিস্তানি রাজাকারদের হাতে ধর্ষণের পর গুলিতে নিহত হন ও পরে তাদের দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে রাখা হতো।

গণহত্যা গবেষক আরজে রুমেলের মতে, পাকিস্তানি জল্লাদদের বাঙালি বিরোধী বর্ণবাদ মেনে চলার মাধ্যমে বিশেষ করে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিদের প্রায়শই বানর এবং মুরগির সাথে তুলনা করা হত এবং সৈন্যরা তাদের হত্যা করতে স্বাধীন ছিল।

প্রখ্যাত গবেষক রবার্ট পেইন তার বই ম্যাসাকার: দ্য ট্র্যাজেডি অব বাংলাদেশে" পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র জেনারেলকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, তাদের মধ্যে ত্রিশ লাখকে মেরে ফেলো, বাকিটা আমাদের হাত থেকে খেয়ে ফেলবে।

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিন বলেছিল, ১৯৭১ সালের গণহত্যা ছিল পোল্যান্ডে নাৎসিদের চাইতেও ভয়াবহ।

যদিও পাকিস্তান দাবি করে, তাদের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করার অধিকার ছিল। ১৯৭১ সালের নৃশংসতা ও রক্তপাতের জন্য ভারতের সাথে থাকা বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দায়ী ছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্র ভুলভাবে যুক্তি দেয়, উভয় পক্ষই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আর তাই একা পাকিস্তানের কাছ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমা আশা করা অযৌক্তিক।

জাভেদ জব্বারের "সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দ্য আনটোল্ড স্টোরি" নামে সাম্প্রতিক একটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, ইয়াহিয়া খান প্রমাণ করার চেষ্টা করেন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল। কারণ ভারতের প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী অবাঙালিদের এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছিল।

যদিও শর্মিলা বোসের "ডেড রেকনিং" বইয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ মৃত্যু, আহত ও ধর্ষণের বিষয়ে বাংলাদেশিদের দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

কিন্তু অসংখ্য সংবাদ প্রতিবেদন, সাক্ষ্য, কূটনৈতিক মামলা এবং অন্যান্য নথি প্রমাণ করে গণহত্যার বাস্তবতা।

এখানে জাতিসংঘের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ বলছে, মানব ইতিহাসের গণহত্যার মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে। প্রতিদিন গড়ে ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ মানুষ নিহত হয়। গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ দৈনিক গড়। তবুও, বিশ্ব সংস্থাটি ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে নীরব ছিল, যদিও এটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আর্মেনিয়ান গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বসনিয়ান, কম্বোডিয়ান এবং রুয়ান্ডার গণহত্যার বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতি এমন একটি বিষয় যা বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যুদ্ধে হতাহতদের জন্য ন্যায়বিচারের একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হবে।

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের শেষ দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন বাঙালিদের গণহত্যার বিশদ বিবরণ দিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে।।

লেমকিন ইনস্টিটিউট জানায়, “অপরাধের বিস্তৃত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, লেমকিন ইনস্টিটিউট (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে) জাতিসংঘকে আহ্বান করে অবিলম্বে বাঙালি গণহত্যায় শিকার মানুষেদের প্রতি শ্রদ্ধা স্বরুপ স্বীকৃতি দেয়া এবং সেই সাথে অপরাধীদের জবাবদিহি করা হোক।"

সত্য ও ন্যায়ের সন্ধানে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার জন্য তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এখনও পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। এমনকি বাংলাদেশে তাদের চালানো ব্যাপক গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি এটি ১৯৭২ সালে প্রধান অপরাধী হিসাবে বাংলাদেশের চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেনি।

এছাড়াও দেখা যায়, পাকিস্তান তাদের পাঠ্যপুস্তক, জাদুঘরে মূলধারার বর্ণনার বিপরীতে ইতিহাসকে বিকৃতি করে আসছে। তাদের অতীতে সংঘটিত ইতিহাস মুছে ফেলছে।

পাকিস্তানের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যেসব অপরাধের কথা উল্লেখ করেছেন তা প্রমাণ করে, ঐতিহাসিক স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না।

বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্রুত পরিবর্তন হওয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

১৯৭১ সালের আঘাতটির প্রতীকী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে এবং সেই সাথে বাস্তব ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।

পাকিস্তান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close