অবশেষে ওএসডি হলেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান-সচিব

প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে অবশেষে ওএসডি হলেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন এবং সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা। তাদের দুজনকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যশোর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আহসান হাবীবকে। সচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামান সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক সরকার।
সম্পর্কিত খবর
ওই শিক্ষা বোর্ডের সদ্য প্রত্যাহার হওয়া চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব এ এম এইচ আলী আর রেজার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত শেষে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ্র স্বাক্ষরিত চিঠিতে মঙ্গলবার এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির আদেশে অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজাকে বদলি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৮ অক্টোবর যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতি করে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চেয়ারম্যান, সচিবসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মামলার আসামিরা হলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন, সচিব অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজা, হিসাব সহকারী আবদুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিকের ছেলে শরিফুল ইসলাম বাবু ও শাহী লাল স্টোরের মালিকের ছেলে আশরাফুল আলম।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব হারুণ অর রশিদকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধনী এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রস্তুত কমিটির সদস্য হিসেবে সম্মানী বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সেই অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকার বিপরীতে আড়াই হাজার টাকা আয়কর কাটা হয়।
২০২০ সালের ৭ আগস্ট আড়াই হাজার টাকা আয়করের চেক বই প্রস্তুত করা হয়। হিসাব সহকারী আবদুস সালাম চেকের মুড়ি বইয়ে আড়াই হাজার টাকা লিখলেও চেকে প্রাপক হিসেবে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিখে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা ইস্যু করা হয়। চেকে সচিব ও চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন।
সেই চেক শরিফুল ইসলাম বাবু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখায় তার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে টাকা ভাগাভাগি করে নেন। এভাবে শিক্ষা বোর্ডের আয়কর বাবদ ১০ হাজার ৩৬ টাকার বিপরীতে মোট ৯টি চেকের মাধ্যমে জালিয়াতি করে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাৎ করেন আসামিরা। যা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অপরাধ।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের অডিট অফিসার আবদুস সালাম জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়কর বাবদ এসব চেক ইস্যু হয়। পরে দেখা যায়, যশোরের ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং সাতটি ও শাহীলাল স্টোর দুটি চেকের মাধ্যমে বোর্ডের ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছে।
তিনি জানান, চেকের মুড়ির সঙ্গে ব্যাংকের স্টেটমেন্ট মেলানোর সময় এই জালিয়াতি ধরা পড়ে। মুড়িতে উল্লেখ করা অঙ্কের সঙ্গে ইস্যু করা চেকের অঙ্কের মিল নেই।
সোনালী ব্যাংক শিক্ষা বোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক এস এম শাহিদুর রেজা জানান, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে ওই টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
এই মামলা হওয়ার পর শিক্ষা বোর্ডের একই পরিমাণ অর্থের আরও জালিয়াতি ধরা পড়ে। ৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ২ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৮ টাকা তুলে নেয়ার প্রমাণ পেয়ে দুদকে নতুন অভিযোগ দেয় শিক্ষা বোর্ড।
বোর্ডের সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ২০১৭ সাল থেকে শিক্ষা বোর্ডের মোট পাঁচ কোটি টাকা চেক জালিয়াতি করে তুলে নেয়া হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট বিজনেস আইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে আয়কর বাবদ ১২ হাজার ২৭৬ টাকা তুলে নেয়া হয়। একই সালের ৪ অক্টোবর শহরের জামে মসজিদ লেনের নূর এন্টারপ্রাইজের নামে ৫৯ হাজার ৩৫ টাকা তোলা হয়।
২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেসের নামে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকা এবং নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে ৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ২ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৮ টাকা তুলেছেন হিসাব সহকারী আবদুস সালাম।
এ ছাড়া সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামে ৯৪ হাজার ৩১৬ টাকা এবং আবদুস সালামের নিজ নামে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা তোলা হয়েছে।
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের উপপরিচালক এমদাদুল হক বলেন, আমরা আরও প্রায় আড়াই কোটি টাকার চেক জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছি। দুদকে ২১ অক্টোবর আরও একটি অভিযোগ জমা দিয়েছি।
তিনি বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন বোর্ডের সচিব থাকাবস্থায় প্রথম জালিয়াতি হয়েছে। আবদুস সালাম তখন হিসাব শাখার দায়িত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক যশোরের শরিফুল ইসলাম বাবু এসব জালিয়াতি করেছেন বলে আমরা জেনেছি। দুদক বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএস