• সোমবার, ২০ মার্চ ২০২৩, ৬ চৈত্র ১৪২৯
  • ||

আদালতকে বিপদে ফেলেছেন দুই জাপানি শিশুর অভিভাবক!

প্রকাশ:  ০৯ মার্চ ২০২৩, ১২:১৯
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাপান থেকে আসা দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের মামলা খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ সময়ের মধ্যে যে যেখানে যেভাবে আছে, সেভাবেই (স্ট্যাটাসকো) থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন।

এ সময় আপিল বিভাগ বলেন, সব সমস্যার সমাধান আদালতে হয় না। দুই শিশুর অভিভাবকই ডেসপারেট, উল্টো আমরা বিপদে আছি।

আদালতে শিশুদের বাবার পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী আকতার ইমাম। আর মায়ের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি। আজ শুনানিকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন দুই শিশুর জাপানি মা এরিকো।

এর আগে বাবা ইমরানের করা মামলাটি গত ২৯ জানুয়ারি খারিজ করে রায় দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান। দুই মেয়েকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দেন। ছোট মেয়ে শুরু থেকে বাবার কাছেই রয়েছে। তাকে উদ্ধারে মা গুলশান থানায় জিডি করেন। পরে তাকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২ ফেব্রুয়ারি তাকে আদালতে হাজির করা হয়। ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালত খাস কামরায় ছোট মেয়ে লায়লা লিনার বক্তব্য শোনেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একদিন বাবার কাছে এবং আরেকদিন মায়ের কাছে থাকার আদেশ দেন আদালত। এরই মধ্যে পারিবারিক আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল করেন বাবা ইমরান শরীফ। পরে জেলা জজ আদালত আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এই আপিলটিই আজ সর্বোচ্চ আদালত তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছেন।

জাপান থেকে আসা দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন বাবা ইমরান শরীফ। মামলায় বাদীপক্ষের তিনজন আদালতে সাক্ষ্য দেন। বিবাদীপক্ষে সাক্ষ্য দেন জাপানি মা এরিকো।

জাপানের নাগরিক এরিকো ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরানের ২০০৮ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হয়। তাদের তিনটি মেয়েসন্তান আছে। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন ইমরান। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে (বড় ও মেজ) নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়ে জাপানে আছে।

ইমরানের কাছ থেকে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে ঢাকায় এসে ২০২১ সালের আগস্টে হাইকোর্টে রিট করেন এরিকো। অন্যদিকে ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে পৃথক একটি রিট করেন ইমরান। পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে একই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেন। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এরিকো, যা চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। পরে এরিকোর করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটি (২০২১ সালে শিশুদের বাবার করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপান থেকে আসা দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। শিশুদের বাবা তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

আদেশে আরও বলা হয়, মামলার পারিপার্শ্বিক বিষয় ও শিশুদের স্বার্থ বিবেচনায় তাদের এ আদালতের এখতিয়ারের বাইরে (দেশের বাইরে) নেওয়া যাবে না। আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিবারিক আদালতে বাবার মামলা খারিজ যে কারণে :

মামলার কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাপানি নারী নাকানো এরিকো ও ইমরান শরীফ দম্পতির বিয়ে, জাপানে তাদের তিন কন্যাসন্তানের জন্ম, তাদের কর্মজীবন, সংসারজীবনের নানা তথ্য উঠে এসেছে এই মামলায়। রায়ে আদালত বলেছেন, জাপান থেকে আসা দুই শিশুর মা-বাবা দুজনই বলেছেন, জাপানে থাকার সময় দুই নাবালিকা শিশু পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিল। তাদের ফল খুব ভালো ছিল। তাদের বাবা দাবি করেন, এ দেশে আনার পর দুই শিশুকে একটা প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করান। একই সঙ্গে তারা অনলাইনে আমেরিকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছিল। আদালত বলেন, জাপানে পড়াশোনা করা দুই মেধাবী শিশুকে বাবার একান্ত চিন্তাভাবনা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত সমীচীন নয়।

আদালত রায়ে আরও বলেছেন, জাপানের টোকিও পারিবারিক আদালতে একই বিষয়ে মামলা চলা অবস্থায় মায়ের সম্মতি ছাড়া বাবা দুই শিশুকে এ দেশে নিয়ে আসেন। একই বিষয়ে জাপানে বিচারাধীন মামলার তথ্য লুকিয়ে একই বিষয়ে মামলা করার সাধারণ যৌক্তিক চিন্তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর বিষয়টি নাবালিকা কন্যাদের মানসিক বিকাশের স্বার্থে নিঃসন্দেহে মারাত্মক ও অনুসরণ অযোগ্য কাজ বলে প্রতীয়মান হয়।

রায়ে এই দম্পতির দুই মেয়ের মতামত তুলে ধরেছেন আদালত। বড় মেয়ে স্পষ্ট বলেছে, তার জন্ম বেড়ে ওঠা জাপানে। বাবার বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। তার স্কুলের সব বন্ধু জাপানে থাকে। সে জাপানে যেতে চায়। রায়ে আদালত বলেছেন, জাপান ছেড়ে আসার আগপর্যন্ত তিন বোন একসঙ্গে ছিল। তারা এখনো বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। সে ক্ষেত্রে অভ্যাসগত বসবাসের জায়গা থেকেও তিন বোনকে বিচ্ছিন্ন করা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে মঙ্গলজনক হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।

এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আদালত বলেন, নাবালক-নাবালিকার হেফাজত ঠিক করার ক্ষেত্রে তাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল বা কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই দম্পতির সব ধরনের তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেছেন, সাধারণ অন্য দশটা মায়ের মতো জাপানি মা তাঁর সন্তানদের দেখভাল করেন। বাবা বাসায় থাকা সাপেক্ষে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন। তবে নাবালিকা কন্যাদের প্রাথমিক যত্নকারী হিসেবে জাপানি মায়ের তুলনায় বাবার কাছে তাদের হেফাজত অধিকতর কল্যাণকর, তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বাদী।

আদালত
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close